বালুমহাল ইজারাদারদের লোভের থাবায় এখন ক্ষতবিক্ষত রাজশাহীর পদ্মার বুক। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করতে গিয়ে ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করছেন তারা। শুধু তাই নয়, বালু পরিবহনের জন্য নদীর বুকে তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। বালু পরিবহনের কারণে নষ্ট হচ্ছে নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। বালু ইজারাদারদের দৌরাত্ম্যে রাজশাহীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের তদারকির অভাবে এখন নদীও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় ক্ষতির মুখে পড়েছে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা নদী সংরক্ষণ বাঁধ। এ অবস্থায় নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষও দুর্ভোগে পড়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নানা কারণে বালুমহালের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। নদী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এভাবে অপরিকল্পিত বালু তোলা বন্ধ না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কোনো কাজে আসবে না। রাজশাহী শহর ঘেঁষে ১৭ কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ রয়েছে। যা নির্মাণে খরচ হয়েছে হাজার কোটি টাকা। নগরীর পশ্চিম প্রান্তের বুলনপুর-সোনাইকান্দি এলাকার নদী তীরবর্তী চার কিলোমিটার বাঁধ সম্প্রতি সংস্কার করা হয়। যাতে খরচ হয় ২৬৬ কোটি টাকা। তবে বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত বালু তোলায় সেই বাঁধ নষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন দিয়েছে।
রাজশাহী নগরীর দক্ষিণের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে বিস্তীর্ণ পদ্মা নদী। রাজশাহী নগরীসহ গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট, বাঘা উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদীর মোট ১১টি আলাদা পয়েন্ট বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী জেলা প্রশাসন নদীর এই পয়েন্টগুলো ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় করেছে ২৫ কোটি টাকা। তবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে চায়নি জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতর। প্রতি বছর বৈশাখে এক বছরের জন্য এই বালুমহালগুলো সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার শর্তানুযায়ী, নিরাপত্তার কারণে নদীর বাঁধের দুই কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা নিষিদ্ধ থাকলেও ইজারাদাররা সেই নিষিদ্ধ সীমানার মধ্যেই বালু তুলছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে এলে সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি টি-বাঁধের পশ্চিমে পবা উপজেলার হরিপুর ও নবগঙ্গা মৌজার দুজন বালুর ঘাট ইজারাদার রজব আলী ও আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৫০ হাজার করে ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এর আগে গত বছর কাজলা মৌজা থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগে ওই বালুঘাটের ইজারাদার আজিজুল আলম বেন্টুর কাছ থেকেও জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সেখানে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া নদীর প্রবাহ রোধ করে বালু পরিবহনের জন্য যাতায়াতের রাস্তা তৈরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখনো বেন্টু নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন। রাজশাহী নগরী ও এর আশপাশে নদী তীরবর্তী বালুমহাল ঘুরে দেখা গেছে, নিয়ম অমান্য করে প্রকাশ্যে নদী তীরবর্তী বাঁধের কোল ঘেঁষে বালু তোলার হিড়িক পড়েছে। কোনো কোনো বালুমহাল সংশ্লিষ্টরা সেই বালু তুলে সংরক্ষণ করছেন বাঁধের ওপর। এখানেই শেষ নয়, শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে খালের মতো সৃষ্ট জলাধার দিয়ে যে সামান্য পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তাও বন্ধ করে ইট-খোয়া ও রাবিশ ফেলে নদীর মাঝে রাস্তা তৈরি করে ট্রাক নামিয়ে বালু পরিবহন করা হচ্ছে। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢল প্রতিরোধের জন্য পদ্মার বুকে আই-আকৃতির বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে বাঁধগুলোর পশ্চিম পাড়ে পলিমাটি বা বালু জমে। এই পলিমাটি বা বালি খরস্রোতা নদীর স্রোতের তীব্রতা থেকে তীরবর্তী এলাকাকে রক্ষা করে এবং নদীর তীব্র স্রোত তীরের দিক থেকে মাঝ নদীর দিকে সরিয়ে দেয়। অথচ তীর রক্ষার পরিকল্পিত সেই বালুই তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে বাঁধ এলাকার মাটি ও সংস্কার করা বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান জানান, নদী তীর সংরক্ষণ করে বালু তোলায় কোনো সমস্যা নেই। তবে প্রশাসনের পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে বালুমহাল সংশ্লিষ্টরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বালু উত্তোলন করছেন। শহর অংশের নদী থেকে বালু না তোলার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে।